বেশিরভাগ পিতামাতা শিশুদের মানসিক যত্নের চেয়ে শারীরিক যত্ন বেশি নেন। বাচ্চা ঠিকমত খাচ্ছে কিনা, ঘুমাচ্ছে কিনা, বয়সের সাথে সাথে স্বাভাবিক বিকাশ হচ্ছে কিনা তা নিয়ে সারাক্ষন চিন্তা করে। সে তুলনায় বাচ্চার মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে তেমন মনোযোগ দেয় না। কিন্তু শিশুর শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতিও যত্নবান হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন।

শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য তাদের সার্বিক সুস্থতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে, তারা দৈনন্দিন জীবনের চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবিলা করতে পারে না এবং তাদের শিখন ও বিকাশের প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে। এই ব্লগ পোস্টে, আমরা শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার কিছু সহজ ও কার্যকর উপায় নিয়ে আলোচনা করব।

১. ভালোবাসা ও সমর্থন প্রদান করুন

শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তাদের ভালোবাসা ও সমর্থন প্রদান করা। পিতা-মাতা ও অভিভাবকদের উচিত শিশুদের প্রতি তাদের ভালোবাসা ও সমর্থন প্রকাশ করা। এটি তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং তারা বুঝতে পারে যে তারা সুরক্ষিত ও প্রিয়।

উদাহরণ: প্রতিদিন শিশুকে সময় দিন, তাদের সঙ্গে কথা বলুন এবং তাদের অনুভূতি ও সমস্যাগুলো শোনার চেষ্টা করুন।

২. নিজের ইচ্ছাগুলো শিশুর ওপর চাপিয়ে না দেওয়া

শিশুদের শিক্ষাদীক্ষায়, জ্ঞানে ও বুদ্ধিতে ‘পূর্ণ’ করে তোলার জন্য মাঝে  মাঝে পিতাপাতার ইচ্ছাকে তাদের উপর চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু মনে রাখবেন ছোটবেলা থেকেই শিশুদের মানসিক বিকাশ শুরু হয়ে যায়। শিশুর স্বাভাবিক মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নিজেদের আবেগ, চাওয়া পাওয়া তাদের ওপর চাপিয়ে না দিয়ে ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে তারা যেমন সেভাবেই তাদের  বিকশিত হতে দিতে হবে।

৩. নিয়মিত রুটিন তৈরি করুন

শিশুদের মানসিক সুস্থতার জন্য একটি নিয়মিত রুটিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত রুটিন তাদের জীবনে স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা এনে দেয়, যা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।

উদাহরণ: প্রতিদিন একই সময়ে খাওয়া, ঘুমানো ও পড়াশুনা করার অভ্যাস গড়ে তুলুন।

৪. শিশুদের অন্যের সঙ্গে তুলনা করবেন না

প্রতিটি প্রাণী যেমন আলাদা, শিশুর বেলায়ও তাই। শিশুকে অন্য শিশুর সাথে তুলনা করতে থাকলে ছোট থেকেই তার ভেতর হীনমন্যতা জন্ম নেবে। তাকে সবসময় ভালো কাজের জন্য উৎসাহ প্রদান করতে হবে এবং দুষ্টুমি করলে অতিরিক্ত শাসন করা যাবে না। মনে রাখতে হবে, দুষ্টুমি, চঞ্চলতা শিশুর সুস্থ বিকাশেরই অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

৫. শিশুদের মনের কথা জানার চেষ্টা করুন: 

শিশুর আচরণে অস্বাভাবিক কোনো পরিবর্তন দেখা দিলে তার সঙ্গে গল্প কথার ছলে হলেও তা জানার চেষ্টা করুন। পরিবার ও শিশুদের সাথে সময় কাটান, খেলাধুলায় অংশ নিন, গল্পের বই পড়ে শোনান, বা  ঘুরতে বের হন। 

সারাদিনের ইতিবাচক কাজগুলোকে উৎসাহিত দিন। শিশুদের চুপ করিয়ে না দিয়ে তাদের মতামত মনোযোগ দিয়ে শুনুন।

৬. পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ নিশ্চিত করুন

শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। সুষম খাবার তাদের মস্তিষ্কের বিকাশে সাহায্য করে এবং মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখে।

উদাহরণ: শিশুর খাদ্য তালিকায় ফল, সবজি, দুধ, প্রোটিন ও পূর্ণ শস্য অন্তর্ভুক্ত করুন।

৭. পর্যাপ্ত ঘুমের ব্যবস্থা করুন

শিশুদের পর্যাপ্ত ঘুম প্রয়োজন, কারণ ঘুম তাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পর্যাপ্ত ঘুম মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি করে এবং শিশুরা আরও শক্তিশালী ও সজীব বোধ করে।

উদাহরণ: শিশুকে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে পাঠান এবং তাদের ঘুমের জন্য একটি শান্ত ও আরামদায়ক পরিবেশ তৈরি করুন।

৮. শারীরিক কার্যকলাপ ও খেলাধুলার সুযোগ দিন

শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে শারীরিক কার্যকলাপ ও খেলাধুলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শারীরিক কার্যকলাপ তাদের মস্তিষ্কের বিকাশে সাহায্য করে এবং মানসিক চাপ কমায়।

উদাহরণ: প্রতিদিন শিশুকে খেলার জন্য সময় দিন এবং তাদের বাইরের খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করুন।

৯. শিশুকে মত প্রকাশ করার স্বাধীনতা দিন

শিশু মানেই প্রশ্নের ভান্ডার পাশাপাশি তারা কোথায় কোন প্রশ্ন করা উচিত তা জানে না। তাই তারা ভুল জায়গায় ভুল প্রশ্ন করলে বা ভুল কথা বললে অভিভাবকদের উচিত তাদের বকাজকা না করে সুন্দর করে বুজিয়ে বলা। ভয় দেখালে বা বকাজকা করলে তাদের মধ্যে  কুণ্ঠাবোধ জন্ম নেয়  যা পরবর্তী কালে শিশুর মত প্রকাশের ক্ষমতাকে খর্ব করে।

১০. শৈল্পিক কার্যকলাপে সম্পৃক্ত করুন

শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে শৈল্পিক কার্যকলাপ সহায়ক হতে পারে। রঙ করা, আঁকা, গান গাওয়া বা নাচ করা শিশুরা তাদের অনুভূতি প্রকাশ করতে ও মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে।

উদাহরণ: কিডস ওয়ার্কশীট বান্ডেলের রঙ করা ওয়ার্কশীট বা ড্রয়িং কার্যকলাপ ব্যবহার করে শিশুদের সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করুন।

১১. সামাজিক দক্ষতা উন্নয়ন করুন

শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সামাজিক দক্ষতা উন্নয়ন জরুরি। শিশুরা তাদের বন্ধু ও পরিবারের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করে এবং সামাজিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করে মানসিক সুস্থতা বজায় রাখতে পারে।

উদাহরণ: শিশুদের পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে দিন এবং তাদের বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ দিন।

১২. ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করুন

শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে একটি ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। একটি ইতিবাচক ও নিরাপদ পরিবেশ তাদের মানসিক বিকাশে সহায়ক হয়।

উদাহরণ: ঘরে হাসি-খুশি ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখুন এবং তাদের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রাখুন।

১৩. মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে শিক্ষা দিন

শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে শিক্ষা দেয়া গুরুত্বপূর্ণ। তাদের জানানো উচিত যে মানসিক স্বাস্থ্যও শারীরিক স্বাস্থ্যের মতোই গুরুত্বপূর্ণ এবং তারা তাদের অনুভূতি ও সমস্যাগুলো সম্পর্কে কথা বলতে পারে।

উদাহরণ: শিশুদের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে খোলামেলা আলোচনা করুন এবং তাদের জানান যে তারা কখনোই একা নয়।

১৪. পেশাদার সহায়তা নিন

যদি আপনার শিশু মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হয়, তবে পেশাদার সহায়তা নেওয়া জরুরি। একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করে তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করুন।

উদাহরণ: স্কুল কাউন্সেলর বা চাইল্ড সাইকোলজিস্টের সাহায্য নিতে পারেন।

১৫. শিশুদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে চেষ্টা করুন

উদাহরণ: যখন আপনি কোন প্রতিশ্রুতি দেন যেমন তোমাকে বিকেল বেলা ঘুরতে নিয়ে যাবো। শিশুটি তখন সারাদিন অপেক্ষা করে বসে থাকে। কিন্তু আপনি তাকে ঘুরতে না নিয়ে গিয়ে নিয়মিত মিথ্যে আশ্বাস দিলেন। তারপর হয়ত দেখবেন, আপনার সন্তান কিছুক্ষণ মন খারাপ করে অন্য কোনো খেলায় মনোযোগ দিয়েছে। উপর থেকে মনে হতে পারে আপনার এই ‘প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের’ ঘটনা ভুলে গেছে। কিন্তু সত্যটা হলো, বাচ্চাদের মনে এসব ঘটনা খুবই প্রভাব ফেলে যার ফলে সে আস্তে আস্তে আপনার কথার ওপর ভরসা হারাতে আরম্ভ করবে।

১৬. শিশুকে ভুল করতে দিন

শিশুদের ভুল করতে দিতে হবে। ভুল থেকেই সবাই শিখে। ভুল করলে ভবিষ্যতে তারা জীবন, সময়, টাকা ও কঠোর পরিশ্রমের গুরুত্ব বুঝতে পারবে। ভুলের মাধ্যমে তারা বুঝতে শিখবে কোন কাজ করা উচিত নয়  এবং কোনটি উচিত। শিশুদের নিজের কাজ ও দায়িত্বের ভার নিজের কাঁধে নিতে শিক্ষা দিতে হবে। এতে তাদের শুরুতে কিছুটা সমস্যা হলেও তারা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেককিছু বুঝতে শিখবে।

শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমরা কি সচেতন?

শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের অনেক বাবা-মা ও শিক্ষক এখন এই বিষয়ে আগ্রহী হচ্ছেন, তবে আরও প্রচেষ্টা প্রয়োজন। মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে শিশুদের ভালোবাসা, সহানুভূতি এবং নিরাপদ পরিবেশ দেওয়া প্রয়োজন।

শিশুদের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলা, তাদের অনুভূতি বোঝা, এবং তাদের সমস্যাগুলো গুরুত্ব সহকারে নেওয়া উচিত। এছাড়া, বিদ্যালয়ে এবং বাড়িতে শিশুদের ওপর অত্যধিক চাপ না দেওয়া এবং তাদের খেলার সময় ও বিশ্রামের সময় নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিলে তারা আরও সুখী ও সাফল্যময় জীবন যাপন করতে পারবে।

শিশুর মানসিক বিকাশে মায়ের ভূমিকা

শিশুর মানসিক বিকাশে মায়ের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মা শিশুদের প্রথম শিক্ষক, তাই তিনি শিশুর মানসিক বিকাশের প্রথম ধাপগুলি তৈরি করেন। মায়ের ভালোবাসা, যত্ন, ও সমর্থন শিশুর আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে এবং নিরাপত্তা বোধ জাগায়।

গল্প বলা, গান গাওয়া, এবং নানা ধরণের খেলাধুলা ও শিক্ষামূলক কার্যক্রমে মা অংশগ্রহণ করলে শিশুর মানসিক বিকাশ দ্রুত হয়। মা শিশুর চিন্তা-ভাবনা ও অনুভূতি বুঝে তাকে সঠিকভাবে গাইড করতে পারেন, যা তার ভবিষ্যৎ জীবনে সফলতার পথ সুগম করে।

মা যদি শিশুর সাথে সময় কাটান এবং তাকে ভালোবেসে বড় করেন, তবে শিশুর মনোবল বৃদ্ধি পায় এবং সে মানসিকভাবে শক্তিশালী হয়।

শিশুর মানসিক বিকাশে বাবার ভূমিকা

শিশুর মানসিক বিকাশে বাবার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাবা শিশুর প্রথম শিক্ষকের ভূমিকা পালন করেন এবং তার আচার-আচরণ ও মানসিকতা গঠনে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে।

বাবার সঙ্গে সময় কাটানো, কথোপকথন করা, খেলার মাধ্যমে শেখানো, এবং শিশুর কৌতূহলকে উৎসাহিত করা মানসিক বিকাশের জন্য অত্যাবশ্যক। বাবার ভালবাসা ও সঠিক দিকনির্দেশনা শিশুকে আত্মবিশ্বাসী, দায়িত্বশীল ও মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন করে তোলে।

এছাড়াও, বাবার সঙ্গে সুসম্পর্ক শিশুর আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা বাড়ায় এবং ভবিষ্যতে সফল ও সুখী জীবন গঠনে সহায়ক হয়।

উপসংহার

শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখা একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যা সময় ও ধৈর্যের প্রয়োজন। উপরে দেওয়া সহজ ও কার্যকর উপায়গুলো অনুসরণ করলে আপনি আপনার শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সহায়তা করতে পারবেন। তাদের প্রতিটি ছোট সফলতা উদযাপন করুন এবং তাদেরকে শেখার প্রতি ভালোবাসা তৈরি করতে সাহায্য করুন।

কিডস ওয়ার্কশীট বান্ডেল এর মাধ্যমে শিশুদের মানসিক বিকাশ ও শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়াতে পারেন, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী হবে।